একদলীয় আধিপত্যের যুগ
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
১. প্রশ্নঃ ভারতের প্রথম তিনটি সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস দলের আধিপত্য ব্যাখ্যা করো।
অথবা
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কংগ্রেস দলের আধিপত্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।
অথবা
একদলীয় আধিপত্যের অবস্থান ও ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রকৃতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ কংগ্রেসের আধিপত্য/আধিপত্যের প্রকৃতি: ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস দলের আধিপত্যের যুগ ছিল। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস লোকসভার ৪৮৯টি আসনের মধ্যে ৩৬৪টি জয় করে অভূতপূর্ব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। রাজ্য বিধানসভাগুলোতেও কংগ্রেসের আধিপত্য ছিল। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচনেও দলটি এই প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখে। দেশব্যাপী সুসংগঠিত কাঠামো, স্বাধীনতা সংগ্রামের জনপ্রিয়তা, শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব এবং দুর্বল আঞ্চলিকতাবাদ কংগ্রেসের এই আধিপত্যের মূল কারণ।
এক দলীয় আধিপত্যের অবস্থান ভারতীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক প্রকৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। প্রথমত, একদলীয় আধিপত্য দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শের অনুপস্থিতি প্রমাণ করেছিল। বাস্তবেও তা ছিল। তখন বিরোধী দলগুলো সরকারী নীতি সমালোচনা করলেও লোক সভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য শাসক দল এতে কর্ণপাত করেনি। দ্বিতীয়ত, একদলীয় প্রাধান্যের ফলে দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব দেখা দিয়েছিল। অথচ শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কংগ্রেস দলের এই আধিপত্যের প্রকৃতি ছিল বহুদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে এক দলের প্রাধান্য। মূলত ভারতে বহু দলীয় ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। চীন, কিউবা বা মায়ানমারের মতো একদলীয় রাষ্ট্রের বিপরীতে, ভারতে মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে একাধিক দল অংশ নিলেও প্রথম তিনটি সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস নির্বাচনী জয়ের মাধ্যমে আধিপত্য বজায় রাখে। এটি ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যান্য একদলীয় ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
_____________
২. প্রশ্নঃ ভারতীয় জনসংঘ কবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল? এই দলের আদর্শ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ ভারতীয় জন সংঘ ১৯৫১ সালে গঠিত হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
ভারতীয় জনসংঘের নীতি ও আদর্শ নিম্নরূপ:
(ক) অখণ্ড ভারত: দলটি অখণ্ড ভারতের ধারণায় বিশ্বাসী, যেখানে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপর জোর দেওয়া হয়।
(খ) এক দেশ, এক সংস্কৃতি: জনসংঘ ভারতীয় সংস্কৃতির একীকরণের উপর গুরুত্ব দেয়, যা তাদের মতে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি।
(গ) সংস্কৃতি ও আধুনিকতার সমন্বয়: দলটি বিশ্বাস করে যে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে দেশ আধুনিক, প্রগতিশীল এবং শক্তিশালী হতে পারে।
(ঘ) হিন্দি সরকারি ভাষা: জনসংঘ হিন্দিকে ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল, যা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
(ঙ) আণবিক অস্ত্রের সমর্থন: দলটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভারতের আণবিক অস্ত্র তৈরির পক্ষে সোচ্চার ছিল।
(চ) সংখ্যালঘু সুবিধা বিরোধিতা: জনসংঘ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ সুবিধার বিরোধিতা করে, সমান নাগরিকত্বের নীতির উপর জোর দিয়েছে।
৩. ভারতে বিরোধী দলের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ ভারতে বিরোধী দলগুলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সরকারের নীতি ও কার্যক্রমের সমালোচনা করে, জনস্বার্থবিরোধী বিষয়গুলি জনসমক্ষে তুলে ধরে এবং কখনো কখনো সরকারকে সহায়তা করে। যদিও প্রথমদিকে তারা লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব পেয়েছিল, তাদের উপস্থিতি গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ছিল। বিরোধী নেতারা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সরকারকে প্রভাবিত করেছেন। তবে, বিরোধী দলগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব, অসংগঠিত কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত তাদের কার্যকারিতা হ্রাস করেছে। ফলে, তারা প্রায়শই সরকারের বিরুদ্ধে একত্রিতভাবে শক্তিশালী
বিরোধিতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
৪. প্রশ্নঃ বামপন্থী দলসমূহের নীতি ও কার্যসূচি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ বামপন্থী দলসমূহের নীতি ও কার্যসূচিঃ ভারতে শ্রেণীহীন ও শোষণ মুক্ত সমাজ গঠন করা বামপন্থী দল সমূহের উদ্দেশ্য। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব থেকে প্রেরণা নিয়ে ১৯২০ -এর প্রথম দিকে এই দলের আবির্ভাব হয়। ভারতে বামপন্থী দলসমূহের কতগুলো নীতি নিম্নরূপ-
(ক) বামপন্থীরা শ্রমিক ও কৃষকদেরকে সংগঠিত করে সরকারের শ্রমিক ও কৃষক স্বার্থ-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করে।
(খ) বামপন্থী দলসমূহ পুঁজিপতিগণের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে থাকেন।
(গ) বামপন্থী দলসমূহ সমতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার দাবি উত্থাপন করে।
দেশে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সাধন, শিল্পের জাতীয়করণ, ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠন, অনুন্নত শ্রেণীর উন্নয়ন ও উদ্বাস্তদের বিনা ব্যয়ে পুনর্বাসন ইত্যাদি হচ্ছে বামপন্থী দলসমূহের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।
৫. প্রশ্নঃ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- বৈদেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অভাব-অভিযোগ জানাবার জন্য ভারতীয় কংগ্রেস দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এই দলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে আদর্শ ও নীতির কথা ঘোষণা করেছিল তাতে এই দলের নিম্নোক্ত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সমূহ প্রতিফলিত হয়। যথা-
(ক) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ- ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ প্রচার করে। এ মর্মে ১৯৭১ সালে সমবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
(খ) ধর্ম নিরপেক্ষতা- সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা দূরীকরণ করা কংগ্রেসের অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়। দলটি ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী।
(গ) জোট নিরপেক্ষতা- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম লক্ষ্য।
(ঘ) সার্বিক বিকাশ- দারিদ্র দূরীকরণ, বেকার সমস্যা সমাধান করা সহ মানুষের সার্বিক বিকাশের জন্য কংগ্রেস দল গুরুত্ব আরোপ করে।